অনুবাদঃ রাফাত
কিশোরগঞ্জের জীবন ছিল শান্ত, রুটিনমাফিক কর্মব্যস্ততায় পরিপূর্ণ।
বড়রা ব্যস্ত থাকতেন রোজগার ও পেশাগত কাজে, আর ছোটদের দিন কাটত পড়াশোনায়। রঙ আর গতিময়তার ছোয়া খুব কমই লাগতো। ইতিপূর্বে আমি এমন দুটি বার্ষিক উৎসবের কথা উল্লেখ করেছি, যখন ব্যতিক্রমীভাবে এই আপাত স্থির জীবনচক্রে পরিবর্তন ঘটে যেত। একটির বিবরণ আগেই দিয়েছি—ঝুলন উৎসব। এবার বলছি অন্যটির কথা, যা হলো মুসলমানদের ঈদ উৎসব।
তবে আমি ঈদের সেই বিশাল জামাতের কথা বলছি না, যা শহরের পূর্ব প্রান্তের ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হতো। বড় হয়ে কখনো সেখানে যাইনি, শৈশবে গিয়েছিলাম একবার, তা-ও একজন কর্মচারীর কাঁধে চড়ে। সেই স্মৃতি আজ অনেকটাই ঝাপসা, শুধু মনে আছে, সেদিন জীবনের সবচেয়ে বড় জনসমাগম দেখেছিলাম।
আমাদের আকর্ষণ ছিল মূলত তিনটি দৃশ্যে:
১. সাধারণ মানুষের ঈদগাহের দিকে সারিবদ্ধ যাত্রা,
২. এক মুসলিম জমিদার পরিবারের হাতিবাহিনীর শোভাযাত্রা দেখা, যে পরিবারের প্রবীণ একজন সদস্য নামাজের ইমামতি করতেন।
৩. অতঃপর নামাজ শেষে হাতির বহর ও সাধারণ মানুষের বাড়ি ফেরার দৃশ্য দেখা।
এই তিনটি দৃশ্যের প্রত্যেকটির চরিত্র আলাদা ছিল, কিন্তু এই তিন পর্ব একত্রে মিলেই ঈদ আমাদের কাছে পূর্ণতা পেত।
ঈদ যেহেতু চান্দ্রমাসের নিয়ম অনুসারে পালিত হয়, তাই বাংলা ঋতু বা প্রকৃতির সাথে এর সংযোগ নেই। এই স্বাতন্ত্র্য আমাদের মনে ঈদকে সকল হিন্দু উৎসব থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। হিন্দু ধর্মে প্রকৃতি আর ঋতুর সাথে যে গভীর যোগ, ঈদ তা থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিল। ফলে আমাদের মনে হতো, এই উৎসব অর্ধেকটা সম্পূর্ণ মানবক্রিয়া, আর বাকি অর্ধেক যেন মানুষ ও প্রকৃতির ঊর্ধ্বে কোনো রহস্যময় ঐশ্বরিকতার প্রকাশ।
ঈদের দিন ভোর থেকে দেখতাম রাস্তায় সাধারণ মুসলমানদের মিছিল নেমেছে, দলে দলে তারা শহরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত ঈদগাহের দিকে যাচ্ছে। ছোট-বড়, শিশু-কিশোর তরুণ-বৃদ্ধ নির্বিশেষে এই মিছিল অসংখ্য পরিবারভিত্তিক ক্ষুদ্র ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত হতো। আমরা দেখতাম তারা সবাই এক অটুট সংকল্প নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে,
তাদের মুখাবয়ব দেখে মনে হতো তারা অভীষ্ট লক্ষ্য(ঈদগাহ) ঠিক যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ।
আমি এ শ্রেণীর সাধারণ মুসলিমদের আচরণ ও হাবভাবের সাথে খুব ভালোভাবেই পরিচিত ছিলাম। সপ্তাহের দুই হাটবারে আমরা এদের অনেককে দেখতাম— সকালে ভারী বোঝা নিয়ে দ্রুতপায়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। আরেকবার সন্ধ্যায় আসার সময়- কিছুটা ধীরগতিতে হেসে-গল্প করতে করতে বাড়ী ফিরতো। কিন্তু ঈদের দিনে এই মানুষদের চীরচেনা সাধারণ রূপ সম্পূর্ণ পাল্টে যেতো।
ধবধবে সাদা পোশাকে দেখে মনে হতো এদের মধ্যে ভেতরগত একটা মৌলিক রুপান্তরও ঘটে গেছে। মুখমণ্ডলে ফুটে উঠত আশ্চর্য নিমগ্নতা, পিটারের ভাষায় যা ‘inward tacitness of mind’।
এর চেয়েও বিস্ময়কর হচ্ছে শিশুদের মুখেও একই ভাব ফুটে উঠতো!
বড়দের সাথে পার্থক্য যে- শিশুরা রংচঙা জামা পরতো আর বয়স্করা সাদা। কিন্তু তাদের মুখে একই ধরণের গাম্ভীর্য লেগে থাকতো। শিশুরাও গম্ভীর হতে পারে!
এই দৃশ্য দেখতে কেমন সেটা বলে বোঝানো সম্ভব না। যারা রেনেসাঁ যুগের যিশুর শৈশবের পেইন্টিংস দেখেছেন, তারাও সে অনুভূতির সম্পূর্ণতা বুঝতে পারবেন না—যদি না তারা ঈদের সকালে ছোট্ট মুসলিম শিশুদের মুখে ফুটে ওঠা গভীর পবিত্রতা ও গাম্ভীর্যের প্রকাশ প্রত্যক্ষ করেন।
সকাল প্রায় ১০ টার দিকে রাস্তায় ঈদগাহমুখী মানুষের ভীড় ক্রমশ কমে আসতো। তখন আমরা বহু আকাঙ্ক্ষিত হাতির আগমনের অপেক্ষা করতাম।
আমাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে নরসুন্দা নদীর অপর পাড়ের(দক্ষিণ) গাছপালা বাড়ি ঘর ছাপিয়ে হাতিগুলো উদয় হতো। তারপর ব্রিজ পেরিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে কিছুদূর ডান পাশের র্যাম্পের মতো ঢালু পথ বেয়ে নেমে আসতো।
হাতির শোভাযাত্রাটি ক্রমশ বড় হতে থাকতো। ঢাল বেয়ে এ পাড়ে নেমে এসে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ধূলিময় পথে দুলতে দুলতে দ্রুতগতিতে গন্তব্যে এগিয়ে যেতো।
এখানে বলে রাখি যে হাতি কিন্তু আমাদের জন্য একবারে নতুন কিছু ছিলো না। আমরা হাতির সাথে খুব ভালো ভাবেই পরিচিত ছিলাম। কিভাবে জয়কার মাদি হাতি শুকনো মৌসুমে আমাদের বাড়ির সামনের তালগাছে বাঁধা থাকতো সে কথা আগে লিখেছি। সেই হাতিটা সারাক্ষণ সামনে-পিছনে ডানে-বামে দুলতে থাকতো এবং সামনে রাখা কলাগাছকে শূড় দিয়ে পেচিয়ে আস্তো গিলে ফেলতো। এছাড়াও লুন্ধ, গাঙ্গাটিয়া, গুজাদিয়া, তালজাংগা, মশুয়ার হাতিগুলো প্রায়শই দেখতাম। মশুয়ার হাতিটি আমার দেখা সবচেয়ে বৃহদাকৃতির। মহিনন্দের বিশাল দাঁতালো হাতিটি প্রায়শই আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেত।
বুঝাই যাচ্ছে শুধুমাত্র হাতিগুলো আমাদের উত্তেজিত করত না। বরং হাতিগুলোর জাঁকালো সাঁজ, তাদের অভিজাত আরোহীরা, এবং উভয়ে একতালে দুলতে ও ঘুরতে থাকার এই সমন্বয়- দৃশ্যটিকে স্মরণীয় করে তুলেছিল।
হাতিগুলোকে ঈদের দিনের জন্য ভালভাবে স্নান করানো হতো। এরপর কালো কালির সাথে তেল মিশিয়ে কপালে নকশা আঁকা হতো। সিঁদুর দিয়ে কানের প্রান্ত থেকে কপাল পর্যন্ত রাঙানো হতো।
সেদিন তাদের অঙ্গসজ্জার সাথে গলায় লাগানো জিনও ব্যতিক্রমী হতো। পিঠ থেকে নিচ পর্যন্ত ঝোলানো সিল্কের ঝালর কাটা পাড় দুলতো হাটার সাথে সাথে।
সিল্কের পোশাক পরিহিত মুসলিম জমিদাররা নিজেদের ভারসাম্য রাখতে হাতিদের সাথে দোল খেতেন, হাতি ও তারা এমনভাবে মিশে যেতেন- রাজপুত পেইন্টিং-এ যেমনভাবে দেখা যায়। রথযাত্রার দৃশ্য যেমন আমাদের রাজপুত পেইন্টিং এর কথা মনে করায়, তেমন এ হাতির শোভাযাত্রাকে মোগল মিনিয়েচার পেইন্টিং এর সাথে মিলানো যায়।
আমরা বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকতাম আর ক্ষনিক পূর্বে দেখা মানুষের মিছিলের সাথে এ জমকালো শোভাযাত্রাকে কিভাবে মেলানো যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকতাম। যদিও আমরা জানতাম যে দুটো দৃশ্য এক সুত্রেই গাঁথা কিন্তু তারা এতো আলাদা বৈশিষ্ট্যের ছিল যে বাহ্যিকভাবে মিল খুঁজে নিতে কষ্টই হয়।
চাঞ্চল্যের তৃতীয় ও শেষ দৃশ্যঃ প্রত্যাবর্তন। এবার সবকিছু একটু শিথিল, ঢিলেঢালা ভাবে হতো। বয়স্ক, যুবক, শিশুরা কথা বলতে বলতে দ্রুতবেগে হেঁটে যেতো। জমিদারদের কিছুটা ক্লান্ত দেখাতো। সবাই শহরের পশ্চিমে ফিরে যেতো। তাদের মুখে ফোটে উঠত এক রহস্যময় পরিতৃপ্ত হাসি—যেন তাদের মনের সকল আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছে!
প্রাসঙ্গিক আলোচনাঃ
* উপরের অংশটি যে বই থেকে অনুবাদ করা- The Autobiography of An Unknown Indian, Nirad C. Chaudhury, University of California Press Berkeley and Los Angeles, 1968. Page 35,35,36
লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরী ১৮৯৭ সনে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদিতে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল কেটেছে তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহকুমা শহরে।
** উল্লেখিত প্রবীণ জমিদার হচ্ছেন সৈয়দ আবদুল্লাহ(কর্তা সাহেব)। তিনি কুমিল্লার দাউদপুর পরগণা ও হয়বতনগরের জমিদার ছিলেন। তার সাথে এ শোভাযাত্রায় তার পাঁচ পুত্র, ভাগ্নে দেওয়ান মান্নান দাদ খান ও পরিবারের অন্যপুরুষ আত্মীয়রা অংশ নিতেন। হয়বতনগর এস্টেটের জমিদার হিসেবে একমাত্র তিনিই শোলাকিয়ার ঈদগাহের ইমামতি করেছেন। সৈয়দ আবদুল্লাহ ১৯১২ সনে মৃত্যুবরণ করেন।
*** নীরদচন্দ্রের জন্ম ১৮৯৭ সনে, সৈয়দ আবদুল্লাহ ১৯১২ সনে মৃত্যুবরণ করায় বলা যায় বিবরণটির সময়কাল ১৯০৫- ১৯১২ সনের মধ্যে।
**** ২৫০ বছরেরও অধিক সময় থেকে শোলাকিয়া ময়দানে ঈদের নামাজ আয়োজিত হচ্ছে তা ওয়াকফ দলিলসূত্রে জানা যায়। প্রাচীন এ ঈদগাহটি তৎকালীন হাজরাদি পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৫৮৫ সনে হয়বতনগর ও জঙ্গলবাড়ির জমিদারদের পুর্বপুরুষ মসনদে আলা ঈসা খান কোচরাজ রঘু নারায়ণের সামন্ত লক্ষণ হাজোকে যুদ্ধে পরাস্ত করে জঙ্গলবাড়ি দুর্গ ও হাজরাদি পরগণা অধিকার করেন। তারপূর্বে ঈসা খানের প্রপিতামহ সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ, 'গোবিন্দ হাজরা'কে জমিদারি স্বত্ব দান করেন ও পরগণার নামকরণ করেন। ঈসা খানের বংশের ও হয়বতনগর পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ দেওয়ান হয়বত খান আনুমানিক ১৬৮০-১৭০০ সনে জোয়ার হোসেনপুর পরগনায় নিজ হাভেলি নির্মান করার পর থেকে হয়বতনগর ও জংগল বাড়ির দেওয়ানরা ঈদে একত্রে নামাজ পরার জন্য মধ্যবর্তী স্থান হিসেবে শোলাকিয়ার ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়তেন।
***** ১৮২৮ সনে হয়বতনগরের তৎকালীন জমিদার দেওয়ান শাহনেওয়াজ খান(পিতা জেলকদর খান পাগলা সাহেব) ঈদের জামাতের পরিসরের বিস্তৃতি ঘটান। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঈদের জামাতে যোগ দেয়ার জন্য আগত অতিথিদের হয়বতনগর হাভেলির মেহমানখানায় রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা হয়। জমিদারদের ঈদগাহমুখি হাতি ও ঘোড়ার গাড়ির শোভাযাত্রা জমকালো রূপ পায়।
****** ১৯৫০ সনে পুর্ববংগ জমিদারি অধিগ্রহণ আইন পাশ করে প্রাক্বালে হয়বতনগরের জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খান পরিবারের পক্ষ থেকে উক্ত ঈদগাহের জমি ওয়াকফ করে দেন। ঈদগাহের বর্তমান ওয়াকফ মুতাওয়াল্লি দেওয়ান ফাত্তাহ দাদ খান। তিনি দেওয়ান মান্নান দাদ খানের পৌত্র এবং মাতৃসুত্রে সৈয়দ আবদুল্লাহের প্রপৌত্র।