Skip to content
হয়বত খানের বাদশাহি সনদ ও জমিদারির ব্যাপ্তি

হয়বত খানের বাদশাহি সনদ ও জমিদারির ব্যাপ্তি

 
মসনদ-এ-আলা ঈসা খানকে সম্রাট আকবর ২২ টি পরগণার সনদ প্রদান করেছেন এ কথা আবুল ফজল আকবরনামায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিকগন প্রমাণ করেছেন যে ঈসা খান আকবরের বশ্যতা কখনো স্বীকার করেন নি তাই কথিত ২২ পরগণার সনদও গ্রহণ করেননি। ঈসা খানের পিতার বংশধারা 'বাইসওয়ারা'র 'বাইস' রাজপুত থেকে উদ্ভূত বিধায় আকবরের ব্যক্তিগত জীবনীকার 'বাইশ রাজপুত-বাইসওয়ার' সাথে '২২ পরগণা' মিলিয়ে ঈসা খানকে সম্রাটের অধিনস্ত একজন সামন্ত হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু ঈসা খান পূর্ববাংলার 'বারো ভুইয়্যা' কনফেডারেসির প্রধান রাজা ছিলেন। 'ছত্রপতি' উপাধিধারী ভোসলে পরিবারকে যেমন মারাঠা কনফেডারেসির সম্রাট বলা যায় ঈসা খানও মসনদ-এ-আলা উপাধি নিয়ে পুর্ববাংলার রাজা ছিলেন, উপরন্তু তিনি স্বাধীন বাংলা সালতানাতের হোসেন শাহী বংশের উত্তরাধিকারীও। ঈসা খানের মৃত্যুর পর তার পুত্ররাও মসনদ-এ-আলা উপাধি বহন করে কনফেডারেসির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তারা মুঘলবিরোধী তীব্র সংগ্রাম অব্যহত রাখলেও উত্তর-পশ্চিম ভারত জয় করা মুঘলদের বিপুল শক্তির কাছে পরাভূত হন। সম্রাটের সাথে মৈত্রীর স্মারক হিসেবে তাদের জমিদারি, জায়গির প্রদান করা হয়। জমিদারি ও জায়গির পাওয়া পরগণাগুলো আবুল ফজলের '২২ পরগণার' প্রায় অনুরূপ। তবে পারিবারিক তথ্য সুত্রে জানা যায় এর বাইরেও অনেক পরগণা বা মহালে তাদের অধিকার ছিলো । 

ঈসা খানের পরবর্তী বংশধরগনের অধীকারভুক্ত সকল পরগণার তথ্য সঠিক ভাবে এখনো পাওয়া যায় নি। এর একটি কারণ হচ্ছে শায়েস্তা খান,মুর্শিদকুলী খান ও কোম্পানির দেওয়ানী আমলে অনেকগুলো পরগণা হাতবদল হয়ে নতুন মালিকদের কাছে ন্যস্ত হয়। কিছ মূল্যবান সনদ ও দলিলপত্র ভূমিকম্প ও স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় নষ্ট হয়। আবার হয়বত খানের ৪র্থ অধস্তন শাহনেওয়াজ খান ধর্মীয় কারণে অনেক মূল্যবান সনদ নষ্ট করেন। তবে বিভিন্ন গবেষক ১৮৭২ থেকে ১৯২০ সনের মধ্যে বিভিন্ন গবেষণা করে যে সকল তথ্য পেয়েছেন তা নিচে উল্লেখ করা হলো। 

জেমস ওয়াইজের উল্লেখ করা 
সনদঃ


১) সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বের ২১তম বর্ষ হিজরি ১০৫৭(১৬৪৭ ইং) আহমদ ও এওয়াজ মুহাম্মদ খানকে(হয়বত খানের পিতামহ) পাঠানো শাহজাদা সুজার ফরমানে বলা হচ্ছে তারা যাতে চাকলা জাহাঙ্গীর নগরের দেওয়ান মুহাম্মদ জাফরের সাথে দেখা করেন এবং উমদাদুল মুলক ইতিকাদ খানকে তাদের জমিদারীর খাজনা প্রদান করে্ন।

২) ততকালীন বাংলার সুবাদার শাহজাদা সুজার পাঠানো ১০৫৯ হিজরি(১৬৪৯ ইং) তার মনসবদার ও সেনাধ্যক্ষ কর্মকর্তাদের বলা হয় তারা যাতে দেওয়ান মাসুম খানের মালিকানাধীন অঞ্চল ত্যাগ করে এবং পূর্বে সরকার অধিকৃত নওয়ারা কারখানা মাসুম খানের কাছে হস্তান্তর করেন।

৩) সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বের ৪৪তম বর্ষে(১৭০০ ইং) হয়বত খানের কাছে পাঠানো তৎকালীন বাংলার সুবাদার ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের নাতি আজিম-উস-শানের ফরমানে তিনটি আদেশ দেওয়া হয়ঃ

) “হয়বত মুহাম্মদ, হায়াত মুহাম্মদের পুত্রকে আদেশ করা হচ্ছে ৩৭টি যুদ্ধজাহাজ পরবর্তী আদেশের জন্য প্রস্তুত রাখতে যার প্রতিটিতে ৩২ জন করে যোদ্ধা মোতায়েন থাকবে।
খ) পরগনা বুলদাখালের(পরবর্তীতে বরদাখাত) জন্য সরকারের প্রাপ্য ১০২৬১ রুপি, ৭ আনা পরিশোধ করা হোক ।
গ) হয়বত খানকে তার মালিকানাধীন নিম্নোক্ত চারটি পরগনায় পাইবাকি বা সংরক্ষিত জমির ইজারাদার এনায়েতুল্লাহ ও লুতফুল্লাহের খাজনা মওকুফ করার আদেশ দেওয়া হলোঃ
সরকার সোনারগাওয়ের অন্তর্গত বুলদাখাল পরগনা,
সরকার বাজুহাভুক্ত কর্তাবু পরগনা, দরজিবাজু পরগনা, হোসেনপুর পরগনা ।”
এছাড়াও তিনি নসরতশাহী পরগণার অধিকার করতেন তা ওয়াইজের মন্তব্য থেকে জানা যায়।  

দীনেশ চন্দ্র সেনের উল্লেখিত সনদঃ

১) হয়বত খানের
পিতামহ এওয়াজ মুহাম্মদ খানকে উদ্দেশ্য করে সম্রাট শাহজাহানের পাঠানো স্বর্ণাক্ষরে লেখা দুটি সনদ।


ময়মনসিংহ গেজেটিয়ারে উল্লেখিত সনদঃ

১) সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে হায়াত মুহাম্মদ খান( হয়বত খানের পিতা) ঈসা খানের বংশীয়দের ২২টি পরগনার মধ্যে ১১ টির নতুন করে জমিদারীর সনদ লাভ করেন।
পরগনাগুলো হচ্ছেঃ সোনারগাও, কর্তোবা, হাজরাদি, জোয়ার হোসেনপুর, কুরিখাই, বরদাখাত, বরদাখাত মগরা, মহেশ্বরদি, সিন্ধা, দরজিবাজু ,জাফরশাহি।

২) হায়াত খানের মৃত্যুর পর  হয়বত খান সোনারগাও, বরদাখাত, বরদাখাত মগরা, জোয়ার হোসেনপুর লাভ করেন। অন্য পরগনাগুলো কোনোভাবে পুনরায় জঙ্গলবাড়ি বংশীয়দের অধিনস্ত হয়। কিভাবে তা হয় সেটি কোন লেখক উল্লেখ করেন নি। এমনকি হায়াত খান কিভাবে ১১টি পরগনার সনদ লাভ করেন তাও জানা যায় নি।

৩) হয়বত খান শরিফ খানের কন্যাকে বিয়ে করার মাধ্যমে পিতা হায়াত খানের অধিনস্ত মহেশ্বরদি, সিন্ধা, দরজিবাজু পরগনা পুনরায় অধিকার করেন।


ত্রিপুরা গেজেটিয়ারে উল্লেখিত পরগনাঃ

হয়বত খানের কন্যার সাথে ২য় মুর্শিদ কুলী খানের নাতি ও মীর্যা আগা বাকেরের পুত্র মীর্যা আগা সাদেকের বিয়ে হয়। বিয়ের মাধ্যমে আগা সাদেকের তিন ছেলে তিন পুত্র  মীর্জা ইব্রাহিম, মীর্জা আবুল হোসেন, মীর্জা জাফর তাদের নানা হয়বত খানের বরদাখাত, গংগামন্ডল, পাতিকারা লাভ করেন ।



উপসংহারঃ জেমস ওয়াইজের উল্লেখিত ৩ নং সনদ ও গেজেটিয়ারের ২ ও ৩ নং সনদ এবং ত্রিপুরা গেজেটিয়ারের তথ্য বিবেচনা করলে বুঝা যায় হয়বত খান মোট ১১ টি পরগনা সম্পুর্ন অধিকার করতেনঃ

১) সোনারগাও (নারায়নগঞ্জ,ঢাকা,বিক্রমপুর জেলা)
২) কর্তোবা (নারায়নগঞ্জ,ঢাকা,বিক্রমপুর)
৩) জোয়ার হোসেনপুর (কিশোরগঞ্জ সদর,হোসেনপুর,নান্দাইল)
৪) বরদাখাত (কুমিল্লা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা)
৫) বরদাখাত মগরা (কুমিল্লা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা)
৬) মহেশ্বরদি (নরসিংদী জেলা সম্পূর্ণ, নারায়ণগঞ্জ,কটিয়াদি উপজেলা)
৭) সিন্ধা (কিশোরগঞ্জ সদর থেকে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জ জেলা)
৮) দরজিবাজু (কিশোরগঞ্জ সদর থেকে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জ জেলা)

৯) গংগামন্ডল (কুমিল্লা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা)
১০) পাতিকারা (কুমিল্লা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা)
১১  নসরতশাহি(নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা) 

উপরের পরগনাগুলোতে হয়বত খানের নিরঙ্কুশ জমিদারি স্বত্ব ছিলো। 

এছাড়া মনসবদার, জায়গীরদার, খারিজা তালুকদার হিসেবে অন্যন্য পরগণায় তার অংশিদ্বারিত্ব ও মালিকানা ছিলো যা তার বংশধরদের কাছে পাওয়া কাগজপত্র দেখে বুঝা যায়।

রাফাত ২৭/৬/২৪  

Back to blog

Leave a comment

Please note, comments need to be approved before they are published.